বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৩১ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
ঈদের একদিনের ছুটি শেষে মেট্রোরেল চলাচল শুরু ড. ইউনূসকে শেহবাজের ফোন, পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ ঐক্য অটুট রাখার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার প্রয়াত সাংবাদিকদের স্মরণে পটুয়াখালী জেলা রিপোর্টার্স ক্লাবে দোয়া ও ইফতার ভাঙ্গায় দরিদ্র ও অসহায় পরিবারের মাঝে বিনামূল্যে ছাগল বিতরণ ময়মনসিংহে ৫২ ঘন্টায় সাজিত হত্যাকাণ্ডের মুলহোতা মন্টি গ্রেফতার গাজীপুরে ৫ জনকে আটক করে ৩ জনকে ডাকাতির প্রস্তুতি মামলা ও ২ জনকে ননএফআইআর চরভদ্রাসনে আব্দুল করিম কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে নগদ অর্থ বিতরণ ভাঙ্গায় হত্যা মামলা দিয়ে হয়রানির প্রতিবাদে এলাকাবাসীর মানববন্ধন, হৃদরোগে মৃত্যুর অভিযোগ দৈনিক প্রলয় প্রত্রিকার উদ্যোগে ময়মনসিংহে আলোচনা সভা ও ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

কমছে পাখিদের অভয়ারণ্য : বিলুপ্তির পথে দেশি পাখি

মামুন হোসেন, পাবনা

পাখি-সব করে রব, রাতি পোহাইল। কাননে কুসুমকলি, সকলি ফুটিল। মদনমোহন তর্কালঙ্কার’র লেখা বিখ্যাত এ কবিতার মতই ছিল চলনবিল অধ্যুষিত পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া সহ প্রত্যেকটি উপজেলার গ্রাম-অঞ্চলের প্রকৃতি। একসময় এসকল এলাকার মানুষের সকালের ঘুম ভাঙতো বিভিন্ন পাখির কিচিরমিচির ডাকে। সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা এই গ্রাম-বাংলায় অবাধ বিচরণ ছিল বিভিন্ন বন্য পাখিদের। তবে এখন আর গ্রাম-বাংলার প্রকৃতিতে আগের মত পাখির ডাকাডাকি শোনা যায় না।

এই পাখিগুলো মূলত বাঁশঝাড়, বন জঙ্গল বা নদীর ধারে ঘুরে বেড়াত। এ ছাড়া মাত্র দেড় যুগ আগেও চলনবিল অঞ্চলের মাঠ-ঘাটে, বাড়ির পাশের গাছ-পালা, ঝোঁপঝাড়ে ডাহুক, টিয়া, ফিঙ্গে, বুলবুলি, শালিক, টুনটুনি, চড়ুই, প্যাঁচা, মাছরাঙা, ঘুঘু, ময়না, হলদে পাখি বা কুটুম পাখি, সাদা বক, পানকৌড়ি, কালো বক, ধূসর বক, চিল, কাক, কোকিল, কাঠ ঠুকরো, বাবুইপাখি, দোয়েল ও হরিয়াল সহ বিভিন্ন পরিচিত ও অপরিচিত পাখির দেখা মিলত। কিন্তু এখন আর পাখিগুলো তেমন চোখে পড়ে না।

পাখি প্রেমীদের অভিমত, নির্বিচারে বন উজাড়, বাড়ির আশপাশে পুরোনো গাছ কেটে ফেলা, অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন, খাদ্য সংকট সহ বিভিন্ন কারণে আশ্রয় হারাচ্ছে পাখিরা। এছাড়া শিকারিদের কারণেও পাখির সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে বলে জানান তারা। তারা জানান, এখন গ্রামঞ্চলের ফসল খেতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এর ফলে পাখির খাবার ছোট মাছ এবং বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ মরে যায়। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই পাখির খাবারের স্বল্পতা দেখা দেয়। পাখিরা খাবার না পেয়ে এসব অঞ্চলে আর থাকছে না। পাশাপাশি উচ্চমাত্রার কীটনাশক ক্ষেতে ব্যবহারের ফলে পানি বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বিষাক্ত পানি খেয়ে বছরে অসংখ্য পাখি মারা যাচ্ছে বলে জানান তারা।

কথা হয় চাটমোহর উপজেলার নিমাইচড়া ইউনিয়নের সমাজ বাজারের ব্যবসায়ী জাহিদ সরকারের সাথে তিনি জানান, এক সময় তাদের এলাকায় বক, চড়ুই, ঘুঘু, দোয়েল, ডাহুক, চিল, পানকৌড়ি সহ বিভিন্ন পাখিদের অবাধ বিচরণ থাকলেও এখন আর এসব পাখিদের দেখা যায় না। তিনি জানান, প্রতি বছর শীত মৌসুমে তাদের এলাকার শীতলাই জমিদার বাড়ির দীঘি সহ আশেপাশের জলাশয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি আসতো। তবে বর্তমানে উন্মুক্ত জলাশয় না থাকায় এবছর পরিযায়ী বা অতিথি পাখি তেমন দেখা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।

কথা হয় ভাঙ্গুড়া উপজেলার খান মরিচ ইউনিয়নের পাখি প্রেমী নুরুজ্জামান সবুজের সাথে তিনি জানান, এক সময় এই চলনবিল অঞ্চলে পাখিদের অভয়ারণ্য ছিলো। তবে এখন আর নেই। বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন থাকলেও তার যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা না থাকায়, এলাকার প্রাকৃতিক অভায়ারণ্যগুলো সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তাই পাখিরাও অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বলে জানান তিনি।

ভাঙ্গু্ড়া উপজেলার রুপসী গ্রামের আজীম খন্দকার জানান, তাদের গ্রামের নদীগুলোতে আগে ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি পরতো। গাছ ও বাঁশ ঝাড়ে তাদের বাসা দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন প্রয়োজনে গাছ পালা কেটে ফেলায় এসব পাখিদের আর দেখা যায় না।

চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল পাকপাড়া গ্রামের জামাল হোসেন নামের এক বৃদ্ধ জানান, আগে এলাকায় তালগাছ, নারিকেল গাছ, সুপারি গাছে বাবুইপাখির বাসা দেখা যেত। বর্তমানে তালগাছ সহ বিভিন্ন পুরাতন গাছ কেটে ফেলায় বাবুইপাখি ও তার দৃষ্টিন্দন বাসা আর দেখা যায় না।

একই এলাকার বাঘলবাড়ি মাদ্রাসার কৃষি শিক্ষক রাশিদুল হাসান মানিক বলেন, যেকোনো প্রাণীর অস্তিত্ব নির্ভর করে দুটি বিষয়ের ওপর। এর একটি নিরাপত্তা এবং অপরটি খাদ্যের নিশ্চয়তা। পাখির বেঁচে থাকা বা অস্তিত্বের জন্যও এ দুটি বিষয় মুখ্য। তিনি জানান, বর্তমানে আমাদের এলাকায় পাখির অস্তিত্ব হুমকির মুখে। প্রাকৃতিক কারণে নয় এর জন্য বেশি দায়ী মানুষের অসচেতনতা বলে জানান তিনি।

হান্ডিয়াল মুনিয়াদিঘী কারিগরি কৃষি কলেজের পরিচালক রফিকুল ইসলাম রনি বলেন, চাটমোহর একটি চলনবিল বেষ্টিত অঞ্চল। এখানে ছোট ছোট অনেক পুকুর খাল, বিল, ডোবা, জলাশয় রয়েছে। সেই সঙ্গে অনেক ঝোপঝাড়, জঙ্গল, ঘাস, লতাপাতা, বট, পাকুর সহ অনেক ফলজ গাছও রয়েছে। যেগুলো পাখিদের বসবাস ও খাবারের জন্য খুবই উপযুক্ত। তিনি বলেন, তবে পুকুর ও খালে ঘাস নিধনে বিষ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। বিষ প্রয়োগ বন্ধ না করা হলে পাখিরা সব মারা যাবে। তিনি বলেন, সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, ফলজ গাছ ধরে রাখা সহ পাখি সংরক্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন না করা হলে পরিবেশে পাখি টিকিয়ে রাখা অসম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

বাবুই, দেশী চাঁদিঠোঁট এখন তেমন একটা দেখতে পাওয়া যায় না। শেষ কবে এই পাখিগুলো দেখেছেন তা কেউ সহজে বলতেও পারবে না। দেশী পাখিই যেখানে দেখা মেলে না, সেখানে টাইগা চুটকি, নীল গলা, ফিদ্দা নামের ইউরোপীয় পরিযায়ী পাখির দেখা পাওয়া আরও কষ্টকর। অথচ চাটমোহর উপজেলায় ৭৮ প্রজাতির পাখির সন্ধান পায় ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর চাটমোহরে ইউএনও হিসেবে যোগ দেওয়া সৈকত ইসলাম। চাটমোহরে ইউএনও হিসেবে যোগ দেওয়ার পর কিছু কাজে তাকে ছুটতে হতো এক ইউনিয়ন থেকে আরেক ইউনিয়নে। ফটোগ্রাফি ছিল তার খুব পছন্দের ও শখের। তাই গ্রামাঞ্চলে বের হলে কাজ ও দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ছবি তুলতে ভালবাসতেন তিনি। বিশেষ করে পাখির ছবি তোলা ছিল তার অন্যতম শখ।

২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর চাটমোহর উপজেলা পরিষদ চত্বরে প্রথম পাখির ছবি তোলেন এই ইউএনও। সে পাখির নাম ছিল ভাত শালিক। আর সর্বশেষ উপজেলার পাশ্বর্ডাঙ্গা গ্রাম থেকে তোলেন ৭৮ তম পাখির ছবি। সেই পাখিটির নাম ছিল কালিম পাখি। তার তোলা পাখির মধ্যে খুব বেশি দেখা যায়না এমন পাখি হলো নীল কন্ঠ, জল ময়ূর, শাহ বুলবুলি।

সেই সময় চাটমোহরে দেখা পাওয়া উল্লেখযোগ্য পাখির মধ্যে রয়েছে, নীল কণ্ঠ, চোখ গেলো, জল ময়ূর, নীল রাজন, অম্বর চুটকি, কাটুয়া চিল, কমলা বউ, দেশি বাবুই, হটিটি, সাদা খঞ্জন, শাহ বুলবুলি, মোহনচূড়া, বন চড়–ই, ফটিকজল, ভরত, তিলা মুনিয়া, এশীয় বসন্ত বাউরী, কমলা বউ, চোখ গেল, কাবাসি, কসাই পাখি, ভোমরা ছোটন, মেঠো পেট পাপিয়া, সাহেলী, ডাহুক ইত্যাদি। সে সময়ে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রজাতির পাখির সন্ধান মথুরাপুর ইউনিয়নের চিরইল, হান্ডিয়াল, নিমাাইচড়া ও হরিপুর ইউনিয়নের ডাকাতির ভিটা এলাকায়।

দিনে দিনে পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যার অধ্যাপক ড. নাজমুল ইসলাম বলেন, গবেষণার কাজে চলনবিলে গিয়ে দেখেছি। আমরা যেটাকে বালিহাঁস বলি এই হাঁসগুলো একটা সময় শীতের সময় আসতো। আমরা ধরে নেই সেই পাখিগুলো সাইবেরিয়া থেকে আসে, আসলে পাখিগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকেই আসে। এই হাঁসগুলো আসলে চলনবিল এলাকায় রেসিডেন্সিয়াল বার্ডের মত হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, চলনবিলের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে কচুরিপানার আস্তরণ থাকে সেখানে তারা ডিম ফুটায় এবং বাচ্চা দেয়। এখানে তারা সারা বছর থাকে। এছাড়াও যেটাকে আমরা শামুক খোল পাখি বলি এসকল পাখিগুলোর সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, এরকম অসংখ্য পাখি আছে এই জলাভূমিতে। তিনি বলেন, জলাভূমি থাকলে পাখি আসবে। কারণ জলাভূমিতে ছোট ছোট কীটপতঙ্গ থাকে এবং ছোট ছোট মাছ থাকে একারণেই তারা খাবারের সন্ধানে জলাভূমিতে আসে।

তিনি বলেন, জলাভূমি যদি বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে এই পাখিগুলো আর আমাদের অঞ্চলে আসবে না। তিনি আরও বলেন, চলনবিলে বিভিন্ন ডেভলপমেন্ট’র নাম করে সড়ক পথ, রেলপথ, ব্রিজ, কালভার্ট করে খন্ড খন্ড করে ফেলেছে। যে কারণে চলনবিলের যে প্রবাহমান জলধার ছিল সে জলাধার দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এবং সেটি এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে প্রায় এক হাজার বর্গকিলোমিটার থেকে সেটা এখন প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ বর্গ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।

তিনি বলেন, এছাড়াও প্রত্যেকটি নদীর সাথে যে প্রাকৃতিক খাল আছে এই খালের মুখে সুইজগেটগুলো বিভিন্ন বেনিফিটের জন্য তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সুইচগেটগুলো টাইমলি অপারেট করা হয় না। যেমন বিলে ফ্রেসিং গ্রুপ আছে, ফারমার গ্রুপ আছে। বিভিন্ন গ্রুপের বেনিফিট অনুযায়ী কোন জায়গায় পানি ছাড়া ও ঢোকা দরকার, পানিটা বের করা দরকার সেটি টাইমলি মনিটরিং করা হয় না। যার কারণে ওয়াটার কন্ট্রোল এবং কানেক্টিং ক্যানেল এবং রিভারের এই কানেক্টিং কমে যাওয়ার কারণে ওই ওয়েটলেন গুলোতে পর্যাপ্ত মাছ আসে না।

এছাড়াও ওয়াটার কন্ট্রোল স্ট্রাকচারের মুখের সামনে কারেন্ট জাল পেতে রাখে। এজন্য মাছ নদী দিয়ে বিলে ঢুকতে পারে না। তিনি বলেন, শুরুতেই যদি মাছটাকে আমরা আটকে দেই। তাহলে বিলে মাছ আসবে না। এবং মাছহীন বিলে পাখিও আসবে না। এসকল কারণেই পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

পাবনা জেলা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী তারিকুর রহমান বলেন, পাখি টিকিয়ে রাখতে দুইটি বিষয় জরুরি একটি আবাস্থল আরেকটি খাদ্য। পাবনায় প্রাকৃতিক বনায়ন নেই, আছে শুধু সামাজিক বনায়ন। পাখির আশ্রয়স্থল নিশ্চিতে সড়কের ধারে বা বিভিন্ন জায়গায় গাছ রোপণ ও বাগান তৈরি করে পরিবেশ রক্ষার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি গাছ রোপণে উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও নির্বিচারে গাছপালা কেটে স্থাপনা নির্মাণ ও গাছকে রক্ষা করে কিভাবে উন্নয়ন সম্ভব, সে বিষয়ে মানুষের মাঝে বিভিন্ন সচেতনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি।

সংবাদটি শেয়ার করুন :

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । দৈনিক প্রলয়